আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস - একুশে ফেব্রুয়ারি

  পয়েন্ট সমূহ
(লোড হচ্ছে...)
    Image from Wikipedia by Rifat Hasan Jihan

    ভূমিকা:

    বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলা আমাদের মুখের ভাষা। বাংলাতে কথা বলেই আমরা আমাদের মনের ভাব সবচেয়ে সহজে প্রকাশ করতে পারি। বাংলাতেই আমরা গান গাই, বাংলাতেই প্রথম কথা বলতে শিখি। এই বাংলা ভাষা এতো সহজে এমনি এমনি আমরা পাইনি। বাংলা ভাষাকে পাওয়ার জন্য আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এই ভাষাকে পাওয়ার জন্য দিতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত, রাজপথ হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অনেক তাজা প্রাণ ঝড়ে পড়েছে পিচ ঢালা রাস্তায়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করে। এরপরেই বাংলা পায় তার কাঙ্খিত মর্যাদা।

    মাতৃভাষা কী:

    ব্যবহারিক অর্থে মায়ের মুখের ভাষাকেই মাতৃভাষা বলা হয়। সন্তান জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে যে ভাষা শুনে শুনে রপ্ত করে তাই-ই তখন তার মাতৃভাষা হয়ে যায়। একটি দেশ বা বৃহৎ এলাকায় অনেকগুলো ভাষা প্রচলিত থাকে। এর মধ্যে থেকে অধিকাংশ লোক যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাই ঐ নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাতৃভাষা। বাংলা ভাষা হলো বাঙালির ভাষা। এই ভাষায় প্রতিটি বাঙালি একে অপরের সাথে সাচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। তাই বাংলা আমাদের মুখের বুলি, বাংলা আমাদের অহংকার। কবি অতুলপ্রসাদ সেন তার কবিতায় বলেন,

    "মোদের গরব, মোদের আশা
    আ মরি বাংলা ভাষা।" 

    মাতৃভাষার গুরুত্ব:


    মাতৃভাষা হলো মানুষের মনের ভাব আকাঙ্খা প্রকাশের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ কথা ও মনের ভাব প্রকাশ করতে সবচেয়ে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে উন্নতি সাধনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প কিছু হতে পারে না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু মাতৃভাষার চেয়ে মধুর কোনো ভাষা হতে পারে না। কবির ভাষায়,

    "নানান দেশের নানান ভাষা,
    বিনা স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা।"

    মাতৃভাষার মর্যাদার লড়াই:

    বাঙালি জাতি বীরের জাতি। বাঙালিরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য অনেকবার অনেক কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছে। তেমনি বাঙালিরা নিজের দেশের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে রাজপথে ঢেলে দিয়েছিল তাদের বুকের তাজা রক্ত। অনেক মায়ের বুক হয়েছিল খালি, বাংলার দামাল ছেলের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। তবু তারা থেমে থাকেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেই তবে দম নিয়েছে। বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা মাতৃভাষার জন্য নিজেদের প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর দিতীয়টি নেই।

    পটভূমি:

    ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই বাঙালির অধিকার নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। প্রথম আঘাতটাই আসে আমাদের ভাষার উপর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্ণর এক অধিবেশনে ঘোষনা করেন, "Urdu and only Urdu will be the only state language of Pakistan." এই ঘোষনার পর থেকে বাঙালি জাতি ক্ষোভে ফেটে পড়ে। চারিদিকে শুরু হয় মিছিল, সভা ও সমাবেশ। রাজপথ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে।অতঃপর পাকিস্তান সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। তবু বাঙালিরা পিছুপা হটেনি। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ছাত্র জনতা জড়ো হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। বেলা ২ টার দিকে শুরু হয় মিছিল। সেই মিছিলে হঠাৎ করেই পাকিস্তানি পুলিশ এসে এলোপাথারি গুলি চালাতে থাকে। সেদিন ভাষার জন্য জীবন দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শফিকসহ আরো নাম না জানা অনেকে। ভাষার জন্য জীবন দেবার মতো এমন নজির পৃথিবীতে আর নেই। প্রতি বছর বাঙালিরা এই দিনটিকে ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

    আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:

    ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালিদের দ্বারাই দেশব্যাপি পালিত হতো। অতঃপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারি পায় তার কাঙ্খিত মর্যাদা। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা UNESCO এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ৩০তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। এটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। অতঃপর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ১৮৮টি দেশ এই দিনটি পালন করে। ফলে বাংলা বিশ্বে এক বড় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। সেই সাথে সকল দেশ থেকে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শিত হয়।

    স্বীকৃতির উদ্যোক্তা:

    কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিকদের সংগঠন "Mother language of the world" ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাতিসংঘের পরামর্শ মতে তারা এ ধরণের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়ার পর ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব UNESCO এর সদর দপ্তরে পাঠানো হয়। ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর UNESCO এর সাধারণ পরিষদে শিক্ষামন্ত্রী এই প্রস্তাবটি তুলে ধরেন। এর পক্ষে বিশ্বের ২৭টি দেশ সমর্থন দেয়। অতঃপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষনা দেয়।

    বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে সিয়েরালিওনের স্বীকৃতি:

    সিয়েরালিয়ন বিশ্বের বুকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশ। গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত ঐ দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল জাতিসংঘ। সেজন্য সিয়েরালিয়নে পাঠানো হয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীরা সেখানে গিয়ে বিনা রক্তপাতে সেই গৃহযুদ্ধ থামাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশী সেনাবাহিনীদের সৌহার্দপূর্ণ আচরণ ও তাদের মুখে বাংলা ভাষা শুনে সেই দেশের মানুষেরা মুগ্ধ হয়। তারা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাকে তাদের দেশের অন্যতম মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বাংলা ভাষা তথা বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

    স্মৃতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:

    ভাষা আন্দোলন প্রতিটি বাঙালির নিকট একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ও বাংলা ভাষার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে বাঙালিরা নিয়েছে নানান পদক্ষেপ। ভাষা আন্দোলনের সেই গুলি লেগে থাকা আমগাছের অবশিষ্ট অংশ আজও সংরক্ষিত আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালায়। তাছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে অতি যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের অনেক তথ্য ও স্থিরচিত্র।

    ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ’ এর তাৎপর্য:

    ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা বিশ্বের দরবারে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। ভাষার সাথে সাথে দেশ ও দেশের মানুষ পেয়েছে সম্মান ও শ্রদ্ধা। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুনরূপে বিশ্বে প্রকাশের সুযোগ বেড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের মানুষেরাও বাংলাদেশ নামক এই দেশটিকে চিনেছে, এই দেশের সাহসী জনগণ সম্পর্কে জেনেছে। ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মাতৃভাষার উন্নয়নে ও ভাষার বিস্তারে রাখবে ফলপ্রসু ভূমিকা। ফলে আমরা বাঙালিরা বিশ্ব পরিমণ্ডলে হবো পরিচিত, হবো সম্মানিত ও গর্বিত। 

    ২১-এর দীক্ষা:

    ২১ এর দীক্ষা শুধু দিনটিকে জাকজমকের সাথে পালন করাই নয়, দেশ ও জাতিকে মাতৃভাষার মর্যাদা উপলব্ধি করিয়ে দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ করা। ২১ আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে বাঙালি জাতি বীরের জাতি। বাঙালি জাতি ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। এই মর্ম আমাদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আমাদেরকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে। যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে গেছে তাদের লক্ষ্য পূরণে আমাদেরকে সবসময় কাজ করে যেতে হবে।

    আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন:

    ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর UNESCO ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করে। এরপর থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় ১৮৮টি দেশ মাতৃভাষাকে সম্মান জানিয়ে এই দিনটিকে পালন করে থাকে। অনেক বিদেশী জনগণেরাও এসময় আমাদের দেশে আসে আমাদের ভাষা দিবস উদযাপন সচক্ষে পরিদর্শন করার জন্য।  এই দিনে সাধারণ জনগণ শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করে। তাদের পা থাকে নগ্ন এবং মুখে থাকে গাফফার চৌধুরীর সেই গান,

    "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
    একুশে ফেব্রুয়ারি
    আমি কি ভুলিতে পারি।"

    স্মরণে ও বরণে একুশ:

    ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহ্যবাহী দিন। এই দিনে আপামর বাঙালি জাতি শহীদ মিনারে আসে পুস্পস্তবক অর্পন করার জন্য। উক্ত দিনে প্রথম প্রহরে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পন করেন। তারপর একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানান ব্যক্তিবর্গ শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। অতঃপর আপামর সাধারণ জনগণ শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় শহিদের আত্মার প্রতি। এই দিনে মসজিদে মসজিদে ভাষা শহিদদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা হয়। তাছাড়া এই সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয় এই দিনে। 

    উপসংহার: 

    মাতৃভূমি হলো একটি ফুটে থাকা ফুল এবং এর সুগন্ধ হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষার সাথে মানুষের বিনিসুতোর সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকেই। মায়ের মুখের ভাষাতেই সব মনের ভাব, আত্মার ব্যাকুলতা, কল্পনা, প্রেম-ভালোবাসার রূপান্তর ঘটে। মাতৃভাষা মায়ের একটি অংশ। আর এই মাতৃভাষাকে যারা ছিনিয়ে নিতে চায় তাদেরকএ বুকের রক্ত দিয়ে হলেও প্রতিহত করতে হয়। সেই কাজটিই বিশ্বের সামনে করে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলার দামাল ছেলেরা। সেকারণেই তাদের ত্যাগের জন্য শুধু আমরা নই, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আজ তারা সম্মানিত। আর তাদের এই ত্যাগের কারণের বাংলা ভাষা তথা দেশ, জাতি ও জনগণ পেয়েছে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা। তাই ভাষার সম্মানকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের দেশ, জাতি ও সমাজকে হতে হবে সচেতন। তবেই ভাষা শহিদদের ত্যাগ সার্থক হবে।

    Related Posts:

    Disqus Comments
    © 2020 রচনা স্টোর - Designed by goomsite - Published by FLYTemplate - Proudly powered by Blogger