অধ্যবসায়

  পয়েন্ট সমূহ
(লোড হচ্ছে...)
    Image by Pexels from Pixabay

    ভূমিকা:

    'অধ্যবসায়' শব্দের অর্থ হলো চেষ্টা বা সাধনা। কোনো কাজে ব্যর্থতা ও অবসাদের গ্লানি মুছে ফেলে। বার বার চেষ্টা , প্রচেষ্টা বা কঠোর সাধনার মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর নাম অধ্যবসায়। সাধনা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা অধ্যবসায়ের উপাদান। কোনো কাজে প্রথম চেষ্টায় সফলতা লাভ করা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে নিরাশ হয়ে পড়লে জয়মাল্য মিলবে না। বিজয়ীর বেশ ধারণ করার জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়, সংগ্রাম ও উদ্যোগ। অধ্যবসায়ী হতে না পারলে জীবনে পরম আকাঙ্খিত বস্তুটি মরীচিকার মতোই থেকে যায়। জীবনে সফলতা লাভ করতে হলে চাই অধ্যবসায়।

    অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য :

    অবিরাম সাধনা, ক্রমাগত চেষ্টা আর সুদৃঢ় প্রত্যয়ের মধ্যেই অধ্যবসায়ের পরিচয়। অধ্যসায় মানব চরিত্রের একটি গুণ- অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উদ্যোগ, পরিশ্রম, আন্তরিকতা ইত্যাদি কতিপয় মহৎ গুণ সম্পৃক্ত হয়েই অধ্যবসায়ের পরিচয় স্পষ্ট করে তোলে। মানবজীবনের সামনে আছে অনেক কাজ। সেখানে মনের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, উৎসাহে উজ্জীবিত হয়ে, নিরলস সাধনার মাধ্যমে সফলতার অভিষ্ট লক্ষ্য অরজনে আত্মনিয়োগ করলেই অধ্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। বাঁধা ডিঙিয়ে যাবার সাধনাই অধ্যবসায়, লক্ষ্যে পৌছার সাধনাই অধ্যবসায়। অধ্যবসায়ই মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে মানুষকএ আশাবাদী করে তোলে। কবি বলেছেন-
    ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
    একবার না পারিলে দেখ শতবার।’

    অধ্যবসায়ের আবশ্যকতা:

    কর্মজীবনে মানুষের নানা বাধাবিপত্তি আসে। কিন্তু "Life means struggle."। তাই সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হলে জীবনসংগ্রামের মুলমন্ত্র হবে অধ্যবসায়। এজন্য স্ফীত গন্তব্যে পৌছাতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অধ্যবসায়। অবিচলিত অধ্যবসায় ছাড়া কেউ আকাঙ্খার চরম লক্ষ্যে পৌছাতে পারে না। কবি এদিকে লক্ষ্য করে বলেছেন-
    "ও তোর মানব জীবন রইল পতিত
    আবাদ করলে ফলতো সোনা।" 

    অধ্যবসায়ের গুরুত্ব:

    অধ্যবসায়ের গুণে মানুষ তীঘ্ন বুদ্ধি, বিচার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি প্রভৃতি লাভে সামর্থ হয়। অধ্যবসায়ের দ্বারা মানুষ ব্যর্থতার সিঁড়ি অতিক্রম করে সাফল্যের হাত ধরে জয়ের মুকুট পড়ে। মনে রাখতে হবে রাতের ঘোর অন্ধকার কেটে যেমন দেখা যায় সোনালি সূর্য, তেমনি বার বার চেষ্টার ফলে মানুষের ভাগ্যাকাশে উদিত হয় সাফল্যের শুকতারা। এভাবে পৃথিবীতে যা কিছু মহৎ, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর সবই অধ্যবসায়ের দ্বারা অর্জিত হয়েছে। ব্যর্থতা জীবনে আসবেই। তাই ব্যর্থতাকে সাফল্যের প্রথম সোপান হিসেবে নিয়ে অধ্যবসায়ী হওয়া প্রয়োজন। অধ্যবসায়ীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধী করে কবি বলেছেন-
    "ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর! বাঁধো বাঁধো বুক
    শত দিকে শত দুঃখ আসুক আসুক।"

    ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়:

    ছাত্রজীবন হচ্ছে ভবিষ্যত জীবন গঠনের ভিত। তাই ছাত্র জীবনে অধ্যবসায়ের আবশ্যকতা কতটা গুরুত্ববহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংস্কৃত শাস্ত্রে ছাত্রদের বলা হয়েছে-"ছাত্র নং অধয়ন নং তপঃ" তপস্যাতেই ছাত্ররা সকল কর্মপন্থার উৎকৃষ্ট কর্মপন্থা অবলম্বন করতে শেখে। বিদ্যার্জনের পথ কুসামাস্তীর্ণ নয়। তাই ছাত্রজীবনের বিফলতা আসা স্বাভাবিক। তবে কোনো ব্যর্থতাই চূড়ান্ত নয়। ছাত্রদের হতাশ হলে চলবেনা। তাদের হতে হবে কঠোর অধ্যবসায়ী। তাই ছাত্রদের ব্রত হওয়া উচিত-

    "আসবে পথে আধার নেমে
    তাই বলে কি রইবো থেমে?"

    ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়:

    ধনে মানে অবদানে ব্যক্তিপতভাবে মহিমান্বিত হওয়ার পূর্বশর্ত মানুষকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। অধ্যবসায়কে করতে হবে জীবনের মূলমন্ত্র। অধ্যবসায় ব্যক্তিজীবনে সফলতা এনে দেয়। তাই ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজন কাজের আগ্রহ, বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, সুদৃঢ় সংকল্প। কেননা সুখের উপকরণ জীবনে আরোপিত নয়, তাকে অর্জন করতে হয়। সে অর্জন সম্ভব নয় দুর্বল হাতে, সম্ভব নয় অলস মানসিকতায়। ব্যক্তির যোগ্যতা ও কঠিন অধ্যবসায় দ্বারা এসব উপকরণ সংগ্রহ করে নিতে হয়। অধ্যবসায় দেখানোর যথার্থ সুযোগ থাকে ব্যক্তিগত জীবনে। জীবনকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা যায় এই মহৎ গুণের সাহায্যে। বড় হওয়ার সাধনায় অধ্যবসায়ের ভূমিকা অনন্য। বলিষ্ঠ অধ্যবসায় থাকলে জীবন হয়ে উঠে সুখের সাম্রাজ্য।

    জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়:

    যে জাতি যত বেশি অধ্যবসায়ী সে জাতি তত বেশি উন্নত ও সম্মানিত। জাতির জ্ঞানী, গুণী, শ্রেষ্ঠ বীর, আবিষ্কারক, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক, শিল্পী, সাহিত্যিক সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সীমাহীন সাধনার দ্বারাই নিজের সারি থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌছেছেন। এমন সব মানুষদের দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করলে দেখলে দেখা যাবে এর মূলে ছিল অধ্যবসায়। এজন্য জাতির সগৌরব প্রতিষ্ঠার জন্য সামগ্রিকভাবে সকল নাগরিককে অধ্যবসায়ী হতে হবে। সকলের একনিষ্ঠ সাধনাই জাতীয় মর্যাদা  বৃদ্ধি করতে পারে এবং সার্বিক সাফল্যের মডেল হিসেবে বিশ্ববাসীর নিকট গৃহীত হতে পারে। সুতরাং জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

    অধ্যবসায় ও প্রতিভা:

    কোনো ব্যক্তির যতই প্রতিভা থাক, অধ্যবসায় না থাকলে সে প্রতিভা অঙ্কুরেই শুকিয়ে যায়। আবার, জগতে বড় হতে হলে অসাধারণ প্রতিভাবান হতে হবে এই কথাটাও অমূলক। কারণ, "Industry is the mother of good luck." অর্থাৎ পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। কোনো কোনো সময় অধ্যবসায়ের জ্ঞান, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী না হয়েও বড় কার্য সাধন করা যায়। ভলতেয়ার বলেছেন, "প্রতিভা বলে কিছুই নাই। পরিশ্রম সাধনা করে যাও তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।" এসম্পর্কে ডাল্টনের কথাও স্মরণযোগ্য, "লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানিনা।" সুতরাং বলা যায়, প্রতিভা নয় অধ্যবসায়ই জীবন সাধনার মূলমন্ত্র।

    অধ্যবসায় সাফল্যের চাবিকাঠি:

    পরাজিত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়া কোনো সুবিবেচকের কাজ নয়। স্মরণ রাখতে হবে- "Failure is the pillar of success." যিনি বিফলতার তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে অধ্যবসায়ের সাথে পুনঃপুনঃ চেষ্টা চালান, সফলতা তার জন্য সুনিশ্চিত। বিফলতার ভগ্ন মনোরথে না থেকে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজে মনোনিবেশ করা উচিত। অধ্যবসায়ের শক্তি যার যত বেশি সে তত বেশি প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। অবিচলিত অধ্যবসায়ের দ্বারা সফলতার চরম লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব। তাই বলা যায়, একমাত্র অধ্যবসায়ই মানব জীবনের সোনালী অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

    অধ্যবসায়ের উদাহরণ:

    ইতিহাসের পাতা উল্টালে অধ্যবসায়ের অসংখ্য ও অগণিত দৃষ্টান্ত মেলে। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস ইংল্যান্ডের রাজা এডয়ার্ডের সাথে ছয়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যখন নিরাশ তখন একটি মাকড়সাকে সাতবার চেষ্টা করে বাসা বানানো শেষ করতে সক্ষম হতে দেখে তার উৎসাহ বেড়ে যায় এবং সেই দীক্ষা নিয়ে তিনি পরবর্তী যুদ্ধে জয়লাভ করেন। নেপোলিয়ন তার কাজকর্মে রেখে গেছেন অধ্যবসায়ের অপূর্ব নিদর্শন। কোনো কাজকেই তিনি অসম্ভব বলে মনে করতেন না। তিনি বলেছিলেন,"The word impossible is found in the dictionary of fools." রবার্ট পিল তার অধ্যবসায়কে কাজে লাগিয়েই একদিন বিখ্যাত তর্কবিদ হয়েছিলেন। দার্শনিক প্লেটো সারারাত জেগে পড়াশোনা করতেন এবং নিজের অধ্যবসায়ের উপর তার অটল বিশ্বাসের কারণেই তিনিও বিখ্যাত দার্শনিক হতে পেরেছিলেন। এসব দৃষ্টান্ত থেকে বলা যায় অধ্যবসায় সকল অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে।

    অধ্যবসায় বিমুখের অবস্থা:

    অধ্যবসায়ের অভাবে অনেক প্রতিভা নষ্ট হয়। অধ্যবসায়হীন মানুষ অপদার্থ। তাদের দ্বারা কোনো মহৎ কাজ সম্ভব নয়। সাফল্যের দ্বারপ্রান্তের  তৃপ্তিকর অনুভূতি তাদের নাগালের বাইরে। জীবনে চলার পথে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে মেরুদন্ডহীনভাবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা অনিবার্য। তাদের স্মৃতি বিস্মৃতি কালের অতলে হারিয়ে যায়। সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয় তারা। অধ্যবসায় না করে ভাগ্যচক্রের উপর বিশ্বাস রেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা জানে না পরিশ্রম আর অধ্যবসায় ছাড়া ভাগ্যচক্র স্থবির। তাই জীবনের অধঃপতন অনিবার্য।

    অধ্যবসায় ও মানুষ:

    অধ্যবসায় মানব চরিত্রের একটি উৎকৃষ্ট গুণ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ চেষ্টা ও সাধনা সহযোগে গড়ে তুলছে জীবনকে; সফল, সুন্দর ও সার্থক করেছে পৃথিবীকে। শান্তচিত্তে প্রতিকূলতাকে জয় করার মূলে রয়েছে অধ্যবসায়। নিরন্তর অনুশীলনেই এ বৃত্তির বিকাশ সাধিত হয়। অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই মানুষ গড়ে তুলেছে রোম নগরী, মিসরের পিরামিড, চীনের মহাপ্রাচীর, ব্যাবিলন ও সিন্ধু সভ্যতা। বলা হয়, "Failure is the pillar of success." মানুষ যদি একবার পরাজিত হয়েই দুঃখ-গ্লানিতে নিজেকে ব্যর্থ মনে করে, তাহলে তার উন্নতি জীবনে কখনো সম্ভব নয়।

    অধ্যবসায় ও উন্নত বিশ্ব:

    উন্নত বিশ্ব কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর কর্মের সঙ্গে অধ্যবসায়ের রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক। অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্সসহ আরো কয়েকটি দেশ সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেছে।

    অধ্যবসায় ও বাঙালি জাতি:

    আমরা বাঙালি জাতি। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, আমাদের অনেকের মধ্যে অধ্যবসায়ের মহৎ গুণটি অনুপস্থিত। আমাদের মধ্যে নেই কোনো প্রচেষ্টা, নেই কোনো উদ্যম, কোনো আগ্রহ। বরং আছে আস্ফালন, হুঙ্কার, গরিমা ও নিজেকে প্রকাশ করার মিথ্যে বাহাদুরি। কেবলমাত্র অধ্যবসায়ের অভাবে আজ আমরা এত পিছিয়ে আছি। জাতি হিসেবে আমরা তাই অনুন্নত। সুতরাং আর একটি মুহূর্তও বিলম্ব না করে নিজেদেরকে অধ্যবসায়ী রূপে গড়ে তোলা খুবই জরুরি

    উপসংহার:

    পরিশেষে বলা যায় যে, জীবনে সাফল্য লাভের জন্য অধ্যবসায় অত্যাবশ্যক। অধ্যবসায়কে জীবনের একটা লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।  ছাত্র ছাত্রীসহ সকল স্তরের মানুষের মধ্যে থাকতে হবে দুর্জয় অধ্যবসায়। তবেই সবক্ষেত্রে সাফল্য অনিবার্য। সেই বিখ্যাত চিরন্তনী বাণীটি আমাদের সবারই স্মরণে রাখা উচিত- "সুন্দর দিন সবার জন্যই অপেক্ষা করে কেউ ডেকে আনে আর কেউ আনে না।" এই আনা না আনার সাথে অধ্যবসায়ের সম্পর্ক। সুতরাং স্বীয় অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সুন্দর জীবন আনয়নই মানবজীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। 


    Related Posts:

    Disqus Comments
    © 2020 রচনা স্টোর - Designed by goomsite - Published by FLYTemplate - Proudly powered by Blogger